সিলেটের সাদাপাথর হরিলুটে জড়িত ১০৩ জন

প্রকাশিত: ১১:৪২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৭, ২০২৫

সিলেটের সাদাপাথর হরিলুটে জড়িত ১০৩ জন

ডেস্ক রিপোর্ট : অবশেষে ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর হরিলুটে জড়িতদের প্রাথমিক তালিকা তৈরী করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রাথমিক তালিকায় উঠে এসেছে ১০৩ জনের নাম। তালিকাটি এখন যাচাই–বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এর পরই পাথর লুটেরাদের ধরতে তালিকা হাতে নিয়ে অভিযান শুরু হবে। এমন তথ্য জানিয়েছেন, সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ।

তিনি বলেন, ‘পাথর লুটপাটে জড়িত ব্যক্তিদের একটি প্রাথমিক তালিকা করেছে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখন যাচাই–বাছাই করে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।’

সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে একটা তালিকা তৈরি হয়েছে। এটি যাচাই–বাছাই শেষে চূড়ান্ত করা হবে। এরপর দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে যেসব অভিযুক্ত শনাক্ত হচ্ছেন, তাঁদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, পাথর লুটপাটকারীদের তালিকায় লুটপাটে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে রাজনৈতিক দলের নেতা ও এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিরা আছেন। পাশাপাশি লুটপাটে ব্যবহৃত বারকি নৌকার মালিক এবং পাথর ক্রয়-বিক্রয়ে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাও আছেন।

তবে, শনিবার ভোরে সাদাপাথর লুটের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া পাঁচজনের নাম ওই তালিকায় আছে কী-না তা নিশ্চিত করতে পারেননি কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনান। তিনি বলেন, শুক্রবার দায়ের হওয়া খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাঁদের আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের কারাগারে প্রেরনের নির্দেশ দেন।
ওসি জানান, শুক্রবার (১৫ আগস্ট) রাতে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে পাথর লুট ও চুরির ঘটনায় প্রায় দেড় হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলাটি দায়ের করেন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ারুল হাবীব। এতে খনি ও খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২-এর ধারা ৪(২)(ঞ) এবং খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৯৩(১) লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী সময়ে গেজেটভুক্ত ওই কোয়ারি থেকে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা কোটি কোটি টাকার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন ও লুট করেছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে জাতীয় গণমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। তবে আসামিদের সুনির্দিষ্ট পরিচয় এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

 

মহাসমারোহে প্রকাশ্যে প্রশাসনের নাকের ডগায় হরিলুট হয়েছে ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর। এতে সরগরম হয়ে ওঠে পুরোদেশ। নানা মহলের সমালোচনার পর অবশেষে পর্যটন শিল্পে ভিন্ন মাত্রা যোগ করা এই পাথর আগের স্থানে ফেরানো হচ্ছে। তবে পাথর ফিরতে শুরু করলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে অনেক। কী পরিমাণ সাদাপাথর লুট হয়েছে- সে তথ্য যেমন নেই প্রশাসনের কাছে, তেমনি কারা পাথর লুটে কারা জড়িত- সেই তালিকাও নেই তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থা, দপ্তরগুলোর হাতে!

স্থানীয়রা বলছেন, সাদাপাথর একদিনেই লুট হয়নি। বছরের পর বছর ধরেই চলছে লুটপাট। সাম্পতিক সময়ে রেকর্ড লুটপাট হয়েছে। দিন ও রাতে সমানতালে শত শত মানুষ লুটপাটে অংশ নিয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় পাথর লুটের মহোৎসব চললেও নিরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ পুরো প্রশাসন।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিদিন যে হারে পাথর লুটে নেয়া হয়েছিল, ফিরছে তার তুলনায় অতি নগণ্য। তাই দৃষ্টিনন্দন এ পর্যটনকেন্দ্র সহসাই আগের রূপে ফিরবে কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।

সাদা পাথর প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি পর্যটনকেন্দ্র। ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথরমহালের ধলাই নদের উৎসমুখে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে জমা হয় পাথর। ঢলের তোড়ে সেখানে সর্বশেষ ১৯৯০ সালে একবার পাথর জমা হয়েছিল। সেসব পাথরকে ‘ধলাসোনা’ বলে অভিহিত করা হয়। তবে পাহাড়ি ঢলের পর লুটপাটে সেসব পাথর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ২৭ বছরের মাথায় ফের পাথর জমা হওয়ায় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পাহারায় সংরক্ষিত হয়। ওই বছর থেকে পুরো এলাকাটি প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়।

সাদা পাথর এলাকার ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল লুংলংপুঞ্জি ও শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি। সেখানকার ঝরনা থেকে সারা বছর নদের পানি প্রবহমান থাকে। বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির পাদদেশ থেকে বর্ষায় ঢলের পানির সঙ্গে পাহাড় থেকে পাথরখণ্ড এপারে নেমে আসে।

সাদা পাথর পর্যটন সৃষ্টি ও তদারকিসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে মধ্য জুলাই পর্যন্ত মোট ১৩ দফা পাহাড়ি ঢল নেমেছিল। তখন উপজেলা প্রশাসন প্রাথমিকভাবে হিসাব করেছে ঢলের তোড়ে ওপার থেকে পাথরের অন্তত ১৩টি আস্তরণ পড়ে। পাঁচ একর জায়গার ওপরে অন্তত ২০ ফুট পুরু পাথরের স্তর জমে। তখন উপজেলা প্রশাসন লুটপাট ঠেকিয়ে পাথরগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২০১৭ সাল থেকে এটি সাদা পাথর পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পায়।

সাদা পাথর এলাকাটির অবস্থান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে।

২০১৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের চেষ্টায় সেসব পাথর সংরক্ষিত হয়েছিল। তখনকার জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার ও ইউএনও আবুল লাইছ নিজ উদ্যোগে পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর উপজেলা প্রশাসন সংরক্ষণের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সর্বশেষ সুমন আচার্য ইউএনও থাকাকালে সাদা পাথর নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেন। সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এলাকাটি ঝুঁকির মুখে পড়ে।

সাদা পাথর যাওয়ার ঘাট হিসেবে পরিচিত ধলাই নদতীরের ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর এলাকা। সেখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটকরা সাদা পাথরে যাননি। এই সুযোগে শুরু হয় লুটপাট। দিন ও রাতে হাজারখানেক বারকি নৌকা ব্যবহার করে সপ্তাহদিন ধরে পাথর লুট চলে। অনেকটা মব স্টাইলে হওয়ায় ভয়ে পুলিশ প্রশাসনও ছিল সাক্ষী-গোপালের ভূমিকায়।

সূত্র : শ্যামল সিলেট

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

ফেসবুকে সিলেটের দিনকাল