নব্বইয়ের দশকের পর থেকে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারণ হয়েছে দেশের অর্থনীতি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিকশিত হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। ২০১৬তে এসে তফসিলভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭। দ্রুত বিকাশমান এ খাতে সুশাসনের অভাবে বেড়েছে ঝুঁকি। এর সঙ্গে বেড়েছে আর্থিক জালিয়াতি ও অপরাধ। দেশের ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন
পর্ব-১
বিদেশী ও চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো বাদ দিলে দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৩৮টি ব্যাংক। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬২ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। আর ব্যাংকগুলোর মূলধন রয়েছে ৬৬ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে ৩৮টি ব্যাংকের মূলধনের ৯৪ শতাংশই খেলাপি। সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একে বিপর্যয়কর বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তফসিলভুক্ত ৩১টি ব্যাংকের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের ও সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে ব্যাংকগুলোর নিট মূলধন হিসাব করা হয়েছে। নিট মূলধনের মধ্যে রয়েছে পরিশোধিত মূলধন, বিভিন্ন প্রকারের সঞ্চিতি, অবণ্টিত মুনাফা, শেয়ার প্রিমিয়ামসহ সব ধরনের ইকুইটি। আর খেলাপি ঋণের তথ্য নেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদন থেকে।
মূলধন ও খেলাপি ঋণের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ৫ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির মূলধনের ১৪৬ শতাংশই খেলাপি ঋণ। আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক অগ্রণীর মূলধনের ১২৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ। ৪ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এছাড়া জনতা ব্যাংকের ৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) ১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৮৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ মূলধনের বিপরীতে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১১৮ ও বিডিবিএলের ৪৮ শতাংশ।
রূপালী ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির মূলধনের ২৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৬ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ বেসিক ব্যাংকের মূলধনের ২৬১ শতাংশই খেলাপি ঋণ। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৪০৬ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৭৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ মূলধনের ২৩৯ শতাংশ। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৪১ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ মূলধনের ১৫৬ শতাংশ। আর মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক দুটির খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৫৪৬ কোটি ও ৪ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা।
দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধূরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব করে তাতে পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন কিংবা অবলোপনকৃত ঋণ ধরা হয় না। এগুলো হিসাবে আনলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের হার ২৫-৩০ শতাংশ হয়ে যাবে। তবে মূলধনের সঙ্গে খেলাপি ঋণের তুলনা করলে ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না।
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে ৪১ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। অবলোপনকৃত এ ঋণ যোগ করলে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে ব্যাংকগুলো অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করে।
মূলধনের ৬০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। ৩ হাজার ৩২০ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এ হিসাবে ন্যাশনাল ব্যাংকের মূলধনের ৭২ শতাংশ খেলাপি ঋণ। এছাড়া প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৬৯৫ কোটি টাকা বা ৬৪ শতাংশ। আইএফআইসির ১ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৮৩৭ কোটি টাকা বা ৬২ শতাংশ এবং ব্যাংক এশিয়ার ১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা বা ৬১ শতাংশ। আর উত্তরা ব্যাংকের ১ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির মূলধনের ৬০ শতাংশ খেলাপি ঋণ।
খেলাপি ঋণ এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান ইস্যু উল্লেখ করে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ছোট অর্থনীতির একটি দেশে ৫৬টি ব্যাংক প্রতিযোগিতা করছে। সব ব্যাংকই স্বল্প সময়ে বেশি লাভ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। গ্রাহক ধরতে ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। ফলে সঠিক গ্রাহক ও যথার্থ মানের ঋণ দেয়া যাচ্ছে না, যা পরে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে ৪ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৫৮ শতাংশ। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৭১৪ কোটি, এসআইবিএলের ১ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ৭৩৮ কোটি, ওয়ান ব্যাংকের ১ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ৬৪১ কোটি ও এনসিসি ব্যাংকের ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৮৫৭ কোটি টাকা। এছাড়া প্রাইম ব্যাংকের ২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬৯ কোটি, আল-আরাফাহ ব্যাংকের ২ হাজার ২৪ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ১ হাজার ৯৪ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৪১ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ৫৫৪ কোটি ও সিটি ব্যাংকের ২ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, কিছু সূচকে দেশের ব্যাংকিং খাতের অবনতি হলেও অনেক সূচকে আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। মানি লন্ডারিং ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সূচকে দেশের ব্যাংকিং খাত উল্লেখযোগ্য সফলতা দেখিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের কারণে মুনাফা করতে পারছে না। খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে মূলধনেও টান পড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
যেসব ব্যাংকের মূলধনের বিপরীতে ৪০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ট্রাস্ট ব্যাংকের ১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৪৫ কোটি, ইউসিবিএলের ২ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ১ হাজার ২৪৬ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের ২ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ১ হাজার ১৬৭ কোটি ও পূবালী ব্যাংকের ২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা ব্যাংকের ১ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৬৬ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১ হাজার ২০৭ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ৫২১ কোটি ও এবি ব্যাংকের ২ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৯৭৬ কোটি টাকা।
ব্যাংকিং খাতের ইকুইটির তুলনায় খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনে বড় বড় ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়াই প্রধান কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ব্যাসেল-২ থেকে এখন দেশের ব্যাংকিং খাত ব্যাসেল-৩-এ প্রবেশ করছে। বর্তমান অবস্থায় দুর্বল মূলধন নিয়ে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করা দুঃসাধ্য হবে।
ব্যাংকিং খাতের মূলধনের অনুপাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যখন শতভাগের কাছাকাছি, তখন বেশ কয়েকটি ব্যাংক তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংকের ২ হাজার ২৪ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৪৮৪ কোটি টাকা, যা মূলধনের প্রায় ২৪ শতাংশ। অন্যদিকে ব্র্যাক ব্যাংকের ২ হাজার ২৪১ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৬৫৩ কোটি, যা মূলধনের ২৯ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং সাউথইস্টের ২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৮০৮ কোটি, যা মূলধনের ২৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর পরই মিউচুয়াল ট্রাস্টের ৯২৮ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ৩১২ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইলের ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার বিপরীতে ৫৭৬ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংকের ১ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার বিপরীতে ৫৩৯ কোটি টাকা ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার বিপরীতে খেলাপি ঋণ ৬৫২ কোটি টাকা।