জীবন কেন ‘ঝা লা পা লা’ করবেন?

প্রকাশিত: ১২:৩৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২৫

জীবন কেন ‘ঝা লা পা লা’ করবেন?

প্রতিক্রিয়া
জীবন কেন ‘ঝা লা পা লা’ করবেন?

 

উজ্জ্বল মেহেদী

জীবন নিয়ে কথা! পাথরের মতো হয়ে শুনছিলাম। পুরো ২৪ ঘন্টা গত হলো। স্রোতের বিপরীত কিছু দেখলাম না। কথার এই আঘাত কষাঘাতও করল না। কারণ, অভিযানিক খ্যাতির কর্তা হয়তো বিড়াল বাসর রাতে মারার তরিকা অবলম্বন করেছেন। করুন। তবে শুরুটা কথার মতো করুণ না হয়।

এই লেখা যখন লিখছি, সাংবাদিকতা জীবন নিয়ে ট্রল হচ্ছে। অন্তর্জালে ছড়ানো হচ্ছে দুঃখ-দুর্দশা-দুর্বিপাক। বিপাকে সাংবাদিকতা। সংহার-প্রহারে বারবার মনে পড়ছে জলতল একজন অগ্রগণ্য বিভুদা- বিভুরঞ্জন সরকারের অকস্মাৎ স্বেচ্ছা-প্রস্থান কথা। বিভুদের জীবন ‘বিদ্রোহী ভৃগু’র মতো নয়। সবসময় কাবু থাকেন। কভু কথা বলেন না। না কথার মধ্যে তার ‘খোলা চিঠি’ এখন শেষ লেখা হয়ে কথা বলছে। লেখার সব কথা খুবলে খাওয়া চলছে। যার যেটুকু দরকার, সেটুকু ছড়াচ্ছে। দেখছি, শুনছি বলে কান বা চোখ ঝালাপালা হওয়ার কথা। জীবন কেন ঝালাপালা হবে?

জীবন জ্বালায় ‘ঝালাপালা’ নিয়ে বলছি। জ্বলাময়ী কিছু নয়, বরং জলের মতো করে বলি। পাথর বা বালুমহাল ইস্যুটি সমগ্র সিলেটের নয়। ১৮৫৪ সাল থেকে ১৯৫০ সাল, তখন এই তল্লাট তথা সিলেট-আসাম ছিল চা-ভূমি।তারও আগে শ্রীহট্ট জমানায় ছিলাম ‘আমলে আসাম’। সেই আমলের কথা জেমস জে. নোভাকের বইয়ে (বাংলাদেশ : জলে যার প্রতিবিম্ব) আছে। মাত্র চারটি উপজেলার খনিজসম্পদ মাত্র। মূল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। তাদের দাপ্তরিক ডালপালা বিস্তৃত নয় বলে বাড়তি দায় বর্তায় জেলা প্রশাসনে। দায়িত্ব পালন অনেকটা উপযাজকের মতো। এহেন কর্ম সম্পাদন এই তল্লাটে কখনো সুকর্ম হয়নি। এ জন্য বিবাদ ফ্যাসাদ। জলজীবিকার এই কর্মযজ্ঞ ভরা বর্ষাতেই জ্বলে ওঠে। দশক তিনেক পেছনে ফিরে তাকালে হাতে বাওয়া একটি হাতিয়ার উঁকি দেয়। নাম ‘বারকি নাও’।

বারকির উদ্ভব কাহিনি বারবার বলি। যাতে এমুখ-ওমুখ হয়ে মুখস্ত হয়ে থাকে। আবারও বলি, এ কাহিনি অনেকটা মার্কিন সেই লোকগাথা জন হেনরির মতো। ইঞ্জিনের সঙ্গে লড়ে যিনি দুনিয়া বিখ্যাত জীবন্ত ইঞ্জিন হয়েছিলেন। আমাদের এক জন বারকি বেচারা ব্রিটিশ নাগরিক। সময়টা আঠারো শতকের প্রথম ভাগ অথবা সতেরো শতকের শেষভাগ হবে। পথ হারিয়ে এই তল্লাটে এসেছিল জন বারকি। তখন পথ একটাই, জলপথ। বেকার প্রান্তিক মানুষের জন্য জলপথে বড় বড় জাহাজ চলাচলের বিপরীতে জন বারকি নির্মাণ করেছিল একটি নৌকা। সেকালে যার কাম, তার নাম। লিখে বা প্রচার করতে হতো না। নৌকার নাম পড়ে জন বারকির নামে। ‘বারকি নাও’।

বারকি বিশেষ একটি নৌকা। কেবল সিলেটেই চলে বলে বাইরে অজানা। পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ চষে বেড়ানো আমাদের ধলাই নদ অববাহিকায় বেড়ে ওঠা সন্তান, ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব শরীফ জামিল একটি সাক্ষাৎকারে নৌকাটির কথা বলেছেন। ‘বারকি’ বলা কথা তার ‘বিশেষ’ নৌকা বলে প্রকাশ হয়েছে। বোঝা বা না বোঝা এখানেই। বারকির ময়ালে সরাসরি বারকি না দেখলে বোঝা দায়। নৌকাটি বিশেষ এ জন্য যে, জলপথে চলা যন্ত্রবিহীন একমাত্র নৌযান। হাতে বাওয়ার শক্তি-সামর্থে টিকে আছে। চলছে দুই-আড়াইশ বছর ধরে। পাথর বা বালুমহালে সনাতন পদ্ধতি কার্যকর করতে বললেই কিন্তু আগে বারকিকে কাছে টানতে হবে। বারকি নাও বা নৌযান ডুবিয়ে-চুবিয়ে শ্রমিককে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে সম্ভব যে নয়, সেটা তো সেই ২০০৮ সাল থেকেই দেখা হচ্ছে।

সব দেখার একটা শেষ থাকে। এইবার শেষ দেখার আস্বাদনের প্রথম পর্বে বিস্মিত করেছে একটি উচ্চারণ। আর তা হচ্ছে, ‘জীবন ঝালাপালা’! জীবন কী করে ঝালাপালা হয়?

একটা কথা মনে গাথা রাখা চাই। এই সিলেট পাথরভূমি নয়, পুণ্যভূমি। পাহাড়ি ঢলে পাথর আহরণ মৌসুমী একটি পেশা মাত্র। শ্রমঘামের পেশাটি আমলাতন্ত্রের তন্ত্রমন্ত্রে গুলিয়ে ফেলে শ্রমজীবীদের অপরাধী আর পাথর পেলেই পাপ ভাবা অনুচিত। তাতে কথার আঘাত কষাঘাত হয়ে কানে বিঁধবে। ঝালাপালা বাদ দিয়ে বারকি শ্রমিকদের তালিকা করুন। বারকি চলুক, শ্রমিক বাঁচুক। বংশ পরম্পরায় যারা বারকি নামের এই বাড়তি শ্রমে নিয়োজিত, তাদেরকে ডাকুন। কাটা দিয়ে কাটা তুলতে, তাদের শ্রমের হাতকে শক্তিশালী করতে ছাড় দিন। পাইলট প্রকল্পে হলেও একটি মহাল ইজারা না দিয়ে সম্পূর্ণ বারকি শ্রমে ন্যস্ত করুন। যন্ত্র দূরে রাখুন। দেখবেন, পাথরে ফুল ফুটবে। যন্ত্রবিহীন, যন্ত্রণাহীন শ্রমঘামের দৃশ্যপট হবে প্রাকৃতিক পর্যটনের সেরা এক আকর্ষণ। তখন জীবন ঝালাপালা করতে হবে না।

‘কান ঝালাপালা’ শুনেছি। সয়েছিও। ‘জীবন ঝালাপালা’ কস্মিনকালেও শুনিনি। কী করে সইব? কলিকালে অনেক কথা শোনা সহজ। হজম সহজ নয়! তাই বদহজম থেকে বলি, জীবন ঝালাপালা করে দেওয়া ঘাতকের কাজ, শাসক-প্রশাসকের নয়। কাজের কাজ হলো, পাথরের পৃথিবীতে পথ বিপৎসংকুল হলে সুন্দর আগামীর সুপথ দেখানো।

লেখক: উজ্জ্বল মেহেদী। সাংবাদিক (‘বারকি, জন বারিকি’ গ্রন্থের লেখক)

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

ফেসবুকে সিলেটের দিনকাল