সাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ‘জুলাই সনদ’?

প্রকাশিত: ৩:৪৫ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৫

সাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ‘জুলাই সনদ’?

সাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ‘জুলাই সনদ’?

 

: জুলাই জাতীয় সনদের যে ‘চূড়ান্ত খসড়া’- তা নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় পার করছে ঐকমত্য কমিশন। দলগুলো স্বাক্ষর করে দিলেই শেষ হবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মূল কাজ। কমিশন বলছে, তারা জুলাই সনদ সাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ দলের সবগুলো এই সনদে সই করবে? এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যে।

যেসব সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার দলগুলো করবে, সেগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে? অধ্যাদেশ জারি করে কতগুলো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব? আসছে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে কতগুলো সুপারিশের বাস্তবায়ন করা যাবে? নির্বাচনের পর নতুন সংসদের কাঁধে কতগুলো সুপারিশ বাস্তবায়নের ভার বর্তাবে? তখন যদি সংসদ প্রয়োজনীয় সমর্থন না পায়, জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ কী হবে?

এরকম নানা প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রেখেই চূড়ান্ত রূপ পেতে যাচ্ছে জুলাই সনদ। ফলে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান রাষ্ট্র সংস্কারের যে দুর্লভ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল, তার কতটা কাজে লাগানো সম্ভব হবে, সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

ঐকমত্যের বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চেয়ে আসছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ কয়েকটি দল। সমন্বিত খসড়ায় জুলাই সনদকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবিধানের উপরে স্থান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ তারা সরকারের কাছে উপস্থাপন করবে। সনদ বাস্তবায়ন দায়িত্ব থাকবে সরকারের ওপর।

কথ ছিল, জুলাই জাতীয় সনদের ‘চূড়ান্ত খসড়া’ ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে সই নেবার জন্য। কিন্তু বৃহস্পতিবারে এসে সেই সময় আরো এক সপ্তাহ বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।

সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সাড়ে ছয় মাসের দীর্ঘ সংলাপের ভিত্তিতে এর আগে প্রাথমিক খসড়ার ওপর দলগুলোর মতামত নিয়ে ‘পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া’ তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে দলগুলো যে মতামত দিয়েছে, তার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে ‘চূড়ান্ত খসড়া’।

সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশন সংশ্লিষ্টরা বহুল আলোচিত এ সনদে সই করবেন। এদিকে, জাতীয় সনদের সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো রাষ্ট্রপতির বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। অন্য সংস্কার প্রস্তাবগুলো অধ্যাদেশ ও সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হবে। পাশাপাশি পুরো সনদকে তফসিল হিসেবে বা অন্য কোনোভাবে সংবিধানে যুক্ত করা হবে।

রোববার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে প্রাথমিকভাবে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের বিশেষ সাংবিধানিক আদেশসংক্রান্ত একটি খসড়া তৈরি করে দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। এই পদ্ধতির নাম ‘রাষ্ট্রপতির বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ’ হবে নাকি অন্য কিছু হবে, এর ‘ফরম্যাট’ (কাঠামো বা বিন্যাস) কী হবে এবং কীভাবে এটাকে বাস্তবসম্মত করা যায়, এসব বিবেচনা করে তাঁরা আজ সোমবারের মধ্যে লিখিত খসড়া ঐকমত্য কমিশনকে দেবেন।

বাস্তবায়নের পদ্ধতি জুলাই সনদের অংশ হবে না। এটি সরকারকে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ বা পরামর্শ হিসেবে দেবে কমিশন। যেসব সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) আছে, সেগুলোও সনদে উল্লেখ থাকবে। তবে এসব বাস্তবায়নের জন্য আলাদা কোনো পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হচ্ছে না বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। সেখানে কিছু ভাষাগত পরিবর্তন আনা হবে। এরপর আগামীকাল মঙ্গলবারের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ ও ‘সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে সুপারিশ’—এই দুটি দলিল রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকারের কাছে পাঠানো যাবে বলে আশা করছে কমিশন।

ছয়টি সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। সনদের তিনটি ভাগ থাকবে। প্রথম ভাগে সনদের পটভূমি, দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে থাকছে সনদ বাস্তবায়নের সাত দফা অঙ্গীকারনামা।

যেসব সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু বিষয় আছে, যেগুলোর জন্য আইন-বিধি পরিবর্তন করতে হবে। কিছু বিষয়ে সরকারি আদেশ প্রয়োজন হবে। এগুলো রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ, বিধি প্রণয়ন এবং সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আর বেশ কিছু বিষয় আছে সংবিধানসংক্রান্ত। মূল জটিলতা সংবিধান সংস্কার–সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন প্রশ্নে। বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে তা আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা প্রকট। সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত মতামত নিয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। বিএনপি সংবিধানসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আগামী জাতীয় সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের পক্ষে। তবে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কিছু দল আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চায়।

জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির প্রক্লেমেশন (রাষ্ট্রপতির ঘোষণা) বা গণভোটের মাধ্যমে এবং এনসিপি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেয়। এর বাইরে অন্তত ১০টি দল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়। এর আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকেও বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছিল।

এদিকে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দাবি করে আসা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা শুরু থেকেই ধরে নিয়েছিলাম, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো আইনগত ভিত্তি পাবে এবং তা বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক হবে। কিন্তু যদি আইনগত ভিত্তি না থাকে, তাহলে এটি কেবল কথার কথা থেকে যাবে–যা জনগণ মানবে না, গুরুত্ব দেবে না।

তার ভাষ্য, বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের পরিস্থিতি বহুবার তৈরি হয়েছে এবং তখনও আইনি জটিলতা পেরিয়ে সমাধানের পথ বের করা হয়েছে। ওদিকে, জুলাই জাতীয় সনদের ভবিষ্যৎ কী এবং বাস্তবায়ন কীভাবে হবে জানতে চাইলে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমরা সকল রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে। সূত্র বলছে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর হতে পারে।