১২ সপ্তাহ থেকে নেই মজুরী, প্রতিবাদে ভূখা মিছিল! আশ্বাস পেয়ে ঘরে ফিরলেন বিক্ষুব্ধ চা শ্রমিক

প্রকাশিত: ৮:৩৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০২০

১২ সপ্তাহ থেকে নেই মজুরী, প্রতিবাদে ভূখা মিছিল! আশ্বাস পেয়ে ঘরে ফিরলেন বিক্ষুব্ধ চা শ্রমিক
নিজস্ব প্রতিবেদক
কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নে জোবেদা টি কোম্পানী লিমিটেডের মালিকানাধীন কালিটি চা-বাগানের শ্রমিকরা ১২ সপ্তাহ থেকে কাজ করেও নায্য মজুরীসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে শ্রমিকরা। প্রায় পাঁচ শতাধিক বিক্ষুব্ধ চা-শ্রমিকরা পেটের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ভূখা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কুলাউড়া শহরে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় সড়ক অবরোধ করে। এতে সংহতি প্রকাশ করেন গাজীপুর ও রাঙ্গিছড়া চা বাগানের শ্রমিকগণ। করোনা পরিস্থিতির সংকটময় মুহুর্তে লকডাউন না মেনে নিজেদের দাবী রক্ষার্থে উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত স্মারকলিপি প্রদান করতে রবিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করেন কালিটি চা-বাগানের শ্রমিকরা। পরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের আশ্বাসে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা অবরোধ তুলে ঘরে ফিরেন।
বিক্ষোভ মিছিলে শ্রমিকগণ মুখে কাপড় বেঁধে (মাস্ক হিসেবে), হাতে প্ল্যাকার্ড ও খালি থালা-বাসন নিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে কালিটি চা বাগান থেকে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ দুইঘন্টা পর দুপুর ১২টায় কুলাউড়া শহরের স্কুল চৌমুহনী এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ এসময় বাঁধা প্রদান করে।
এসময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা এনসি স্কুল চৌমুহনীতে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। খবর পেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম সফি আহমদ সলমান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী তাদের আন্দোলন স্থলে গিয়ে উপস্থিত হন। এসময় শ্রমিকদের মজুরীসহ বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে মালিক পক্ষের সাথে কথা বলে দ্রæত সমাধানের কার্যত আশ্বাস দিয়ে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। এসময় শ্রমিকরা তাদের কথা শুনে ভূখা বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ বন্ধ করে দিয়ে সবাই বাগানে ফিরে যায়। কুলাউড়া থানার অফিসার ইনর্চাজ মো. ইয়ারদৌস হাসান, ওসি (তদন্ত) সঞ্জয় চক্রবর্তীসহ কুলাউড়া থানা পুলিশের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল।
শ্রমিকরা জানায়, কালিটি চা-বাগানটি ‘জোবেদা টি কোম্পানি লিমিটেডের’ নামে সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয়া হয়েছে। বাগানে মোট ১০০০ হাজার শ্রমিক আছেন এর মধ্যে ৫৩৭ জন নিয়মিত শ্রমিক কাজ করেন। প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক ১০২ টাকা করে মজুরি পান। প্রতি সপ্তাহে তা পরিশোধের কথা। কিন্তু ১২ সপ্তাহ ধরে শ্রমিকরা তাদের মজুরি পাচ্ছেন না। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা আরো বেশি ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে। একদিকে বাগানের মজুরী না পাওয়ায় ক্ষুধার জ্বালায় দিশেহারা তারা অন্যদিকে বাইরে কোথায় গিয়েও কোনও কাজ করতে পারছে না তারা। বাগানের মালিকপক্ষ শুধুই টালবাহানা করছে এবং শ্রমিকদের মজুরীসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না করে বাগানটি বিক্রি করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
চা শ্রমিক নেতা বিশ্বজিত দাস বলেন বলেন, একদিকে ১২ সপ্তাহ ধরে মজুরি বঞ্চিত অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঝুঁকিতে আছেন এই বাগানের শ্রমিকগণ। অবিলম্বে এই বাগানের সংকট নিরসন করা না গেলে শত শত চা শ্রমিকের জীবন বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। ২৪ ঘন্টার ভিতর যদি সমাধান না হয় তাহলে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
বাগান শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সম্পাদক উত্তম কালোয়ার জানান, ‘শ্রমিকেরা এমনিতেই সামান্য মজুরি পান। এরপর ১২ সপ্তাহ থেকে কেউ সেই মজুরি পাচ্ছেন না। কাজ করেও মজুরি মিলছে না। ঘরে চাল-ডাল নেই। উপোস দিন কাটাতে হচ্ছে। বাগান কর্তৃপক্ষ আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি বলে সময়ক্ষেপণ করছে।’
বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি শম্ভু চৌধুরী দাশ বলেন, বাগানে দীর্ঘদিন থেকে নানা সমস্যা রয়েছে। শ্রমিকদের আগের মজুরিরও বেশ কিছু টাকা বকেয়া পড়ে আছে। অনেক শ্রমিক জরাজীর্ণ কাঁচাঘরে বাস করছেন। এসব ঘর মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। অবসরে যাওয়া শ্রমিকেরা তহবিলের টাকা পাচ্ছেন না। অথচ প্রত্যেক শ্রমিকের মজুরি থেকে সাত শতাংশ করে ভবিষ্যৎ তহবিলের টাকা কেটে রাখা হয়। এর সঙ্গে মালিক পক্ষ আরও সাত শতাংশ যোগ করে মোট ১৫ শতাংশ টাকা শ্রম অধিদপ্তরে জমা দেওয়া কথা। বাগান কর্তৃপক্ষ তাও করছে না।
মজুরি বন্ধের বিষয়ে কালিটি বাগানের ব্যবস্থাপক প্রণব কান্তি দেব জানান, কোম্পানির কাছ থেকে যথাসময়ে টাকা না পাওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনিসহ বাগানের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ১১ মাসের বেতন বন্ধ আছে বলেও জানান।
কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ইয়ারদৌস হাসান জানান, চা-বাগানের শ্রমিকরা নিজেদের মজুরী প্রাপ্তির দাবিতে উপজেলা সদরে আসার প্রাক্কালে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্ঠা করে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, বাগানের
শ্রমিকদের মজুরীসহ সামগ্রিক সমস্যার বিষয়ে বাগান মালিকপক্ষকে একাধিকবার
চাপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তুু মালিকপক্ষ কোন কর্ণপাত করছেন না। দ্রুত সময়ের
মধ্যে যদি শ্রমিকদের মজুরী পরিশোধ না করা হয় তাহলে বিধি মোতাবেক মালিকের
বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম সফি আহমদ সলমান বলেন, শ্রমিকরা দীর্ঘদিন থেকে মানবেতর জীবন যাপন করছে। পেটের ক্ষুধায় তারা আজ রাস্তায় নেমে এসেছে। করোনা পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে তাদের সার্বিক বিষয় বুঝিয়ে বলা হয়েছে। বাগানের মালিকপক্ষের সাথে আমার কথা হয়েছে। তারা আশ্বস্ত করেছে, দ্রæত সময়ের মধ্যে মজুরীসহ সকল সমস্যা ঘরে ফিরে যায়। ইতোমধ্যে, তাদের মানবিক দিক চিন্তা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বাগানের সাড়ে পাঁচশত শ্রমিক পরিবারে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরো ত্রাণ সহায়তা দেয়া হবে।