إن الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه أجمعين أما بعد:
মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা অপবাদ দুটিই কবীরা গুনাহ এর অন্তর্ভুক্ত। কোন ইমানদার ব্যক্তি এ ধরণের কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে না। ইমানদারদের বৈশিষ্ট্য হলো তারা কখনো মিথ্যার সাক্ষ্য হয় না । আলকুরআনে বলা হয়েছে,
অর্থ: আর যারা মিথ্যার সাক্ষ্য হয় না এবং যখন তারা অনর্থক কথা-কর্মের পাশ দিয়ে চলে তখন সসম্মানে চলে যায় [সূরা আলফুরকান:৭২] | যুগ যুগ ধরে প্রকৃত ইমানদারদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা অপবাদ দেয়া হয়েছে। আলকুরআনে এসেছে,
‘আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি মানুষ ও জিনের মধ্য থেকে শয়তানদেরকে, তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ কথার কুমন্ত্রণা দেয় এবং তোমার রব যদি চাইতেন, তবে তারা তা করত না। সুতরাং তুমি তাদেরকে ও তারা যে মিথ্যা রটায়, তা ত্যাগ কর’ [ আনআম ১১২] । আজকে আমাদের সমাজে নানাভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা অপবাদ দেয়া প্রবণতা বেড়েই চলছে। একজন অপরজনকে ঘায়েল করার জন্য এ দুটি মানবতাবিরোধী কাজ অহরহ চলছে। মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা অপবাদের মাধ্যমে হয়ত সাময়িক লাভবান বা আনন্দিত হওয়া যায়, কিন্তু এর ভয়াবহ পরিণাম দুনিয়াতে যেমনি রয়েছে, তেমনিভাবে আখেরাতেও রয়েছে কঠিন শাস্তি। এসব থেকে বিরত থাকতে আলকুরআনে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে,
‘সুতরাং মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর’ [সূরা হাজ্জ:৩০] । মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা অপবাদ দেয়ার ভয়াবহ পরিণামগুলো হলো:
১.মিথ্যা সাক্ষ্য শিরক সমতুল্য গুনাহ: আল্লাহ তায়ালা শিরক ছাড়া সব ধরণের গুণাহ ক্ষমা করবেন। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া এমন বড় গুনাহের কাজ, যা শিরকের গুনাহের সমতুল্য। হাদীসে এসেছে,
: قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ثَلاَثًا قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ وَجَلَسَ ، وَكَانَ مُتَّكِئًا فَقَالَ أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ قَالَ فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا لَيْتَهُ سَكَتَ.
অর্থ: একবার রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলান দিয়ে বসে ছিলেন এ অবস্থায় তিনি সাহাবাদের বললেন, বড় গোনাহ সম্পর্কে কি আমি তোমাদের বলব? সাহাবাগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ বলুন। রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বড় গোনাহের অন্তর্ভুক্ত হল কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা তথা শিরক করা, মাতা-পিতার নাফরমানী করা। অতঃপর সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া (একথা তিনবার বললেন) [সহীহ বুখারী: ২৬৫৪]।
২.মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার ভাল আমল কবুল হবে না: মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার কারণে ভাল কোন আমল আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। এ বিষয়ে রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মুর্খতা পরিত্যাগ করতে পারলনা, তার রোযা রেখে শুধুমাত্র পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’ [সহীহ বুখারী:৬০৫৭]।
৩.মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কবীরাহ গুনাহ:কেও যদি মিথ্যা সাক্ষী দেয় তবে তা হবে কবীরা গুনাহ। তাওবাহ করা ছাড়া তার উপায় নেই। হাদীসে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، قَالَ سُئِلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم: عَنِ الْكَبَائِرِ قَالَ الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ وَقَتْلُ النَّفْسِ وَشَهَادَةُ الزُّورِ.
আনাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো । উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করা তথা শিরক করা, মাতা-পিতার নাফরমানী করা, মানুষ হত্যা করা ও মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া’ [সহীহ বুখারী:২৬৫৩]।
৪.মিথ্যা সাক্ষ্য বড় যুলূম:মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির উপর যুলুম করা হয়। আর যুলুমের কারণে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দিবে। এ বিপর্যয় কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তির উপর আসবে না, বরং সকেলই এর ভুক্তভুগি হবে। কুরআনে বলা হয়েছে,
‘আর তোমরা ভয় কর ফিতনাকে যা তোমাদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে শুধু যালিমদের উপরই আপতিত হবে না। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর।’ সূরা আনফাল -২৫।
৫.মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা ও গ্রহণকারী উভয় সমান অপরাধী : মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা তার মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার মাধ্যমে যে অপরাধ করেছে ,আর সে অপরাধ যে গ্রহণ করেছে সেও সমান অপরাধী হিসাবে বিবেচিত হবে। ইবনে হাজর রা. বলেন,
عدّ شهادة الزّور وقبولها، كلاهما من الكبائر
মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা ও গ্রহণকারী উভয় সমান অপরাধী ও তারা কাবীরাগুনাহকারী হিসাবে সাব্যস্ত হবে।
৬.মিথ্যা সাক্ষ্য গ্রহণকারী খেয়ানতকারী হিসাবে অভিযুক্ত: যারা বিচার শালিস কওে থাকেন তাদের উপর এক বিরাট আমানতের দায়িতব থাকে। কেননা কুরআনে এসেছে,
নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি যথাযথভাবে কিতাব নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে ফয়সালা কর সে অনুযায়ী যা আল্লাহ তোমাকে দেখিয়েছেন। আর তুমি খিয়ানতকারীদের পক্ষে বিতর্ককারী হয়ো না [ সূরা আননিসা:১০৫] । আর খেয়ানতকারীর শাস্তি ভয়াবহ হবে।
৭.মিথ্যা অপবাদকারী হতভাগা:মিথ্যা অপবাদকারী সাময়িক আনন্দ, কোন প্রাচুর্য পেলে বা তার কোন পদোন্নতি হলেও মিথ্যা অপবাদকারীর চেয়ে হতভাগা আর কেহ নেই। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
তোমরা কি জান গরীব কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সুনান আততিরমীযি ২৪১৮]
৮.বানোয়াট অভিযোগকারীর স্থান জাহান্নাম: কেও কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে কোন বানোয়াট অভিযোগ আনলে তা অভিযোগকারীর জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ হবে। আবু যার রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
নিশ্চয় যারা গো বাছুরকে (উপাস্য হিসাবে) গ্রহণ করেছে, দুনিয়ার জীবনে তাদেরকে আক্রান্ত করবে তাদের রবের পক্ষ থেকে গযব ও লাঞ্ছনা। আর এভাবে আমি মিথ্যা রটনাকারীদের প্রতিফল দেই। [সূরা আলআরাফ:১৫২]
১০.মিথ্যা রটনাকারী ব্যর্থ হয়: মিথ্যা আরোপ করে সফল হওয়া যায় না,মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সাময়িকভাবে কাওকে হেয় করা যায় বা কাওকে পাকরাও করা যায়। প্রকৃকপক্ষে মিথ্যা অপবাদ ব্যর্থ হয়। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿وَقَدۡ خَابَ مَنِ ٱفۡتَرَىٰ ٦١ ﴾ [طه: ٦١]
আর যে ব্যক্তি মিথ্যা আরোপ করে, সে-ই ব্যর্থ হয়। [সূরা তাহা :৬১]
১১.মথ্যা অপবাদ ক্ষণস্থায়ী : মিথ্যা অপবাদ ক্ষণস্থায়ী, এর স্থায়িতব সাময়িক। আলকুরআনে বলা হয়েছে,
‘দেখ, তারা কীভাবে মিথ্যা বলেছে নিজদের উপর, তারা যে মিথ্যা রটনা করত, তা তাদের থেকে হারিয়ে গেল’ [আনআম : ২৪]
আজকের সমাজে যারা মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা অপবাদ দেয়ার মত জঘন্য কাজে সম্পৃক্ত তাদেরকে সতর্ক হওয়া এবং এ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা অনেক জাতিতে তাদের এ দুটি কুকর্মের কারণে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আলকুরআনে এসেছে,
তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, আমি তাদের পূর্বে কত প্রজন্মকে ধ্বংস করেছি, নিশ্চয় যারা তাদের কাছে ফিরে আসবে না [সূরা ইয়াছিন : ৩১]। আমরা যারা এসব অন্যায় কাজ হতে দেখছি তাদেরকেও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। যারা মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা অপবাদ দেয়ার মত জঘন্য কাজে সম্পৃক্ত তাদেরকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য সর্বাত্বক প্রচেষ্টা চালাবে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এই বিষয়ে আমল করার তৌফিক দান করুন আল্লাহুম্মা আমিন।
সাবেকঃ- ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।