গোয়াইনঘাটে প্রশাসনের আক্রোশের শিকার সাংবাদিক ইসলাম আলী

প্রকাশিত: ১১:০০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪

গোয়াইনঘাটে প্রশাসনের আক্রোশের শিকার সাংবাদিক ইসলাম আলী

গোয়াইনঘাটে প্রশাসনের আক্রোশের শিকার হয়ে কারাগারে আছেন জাতীয় দৈনিক সোনালী কণ্ঠ’র সিলেট বিভাগীয় প্রধান মো. ইসলাম আলী। ইসলাম আলী গোয়াইনঘাট উপজেলার ৬নং ফতেপুর ইউনিয়নের লামা ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং স্থানীয় গোয়াইনঘাট উপজেলার ইউনাইটেড মেটারনিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে ছিলেন। কয়েকদিন আগে কিছুনামধারী সাংবাদিক ইউনাইটেড মেটারনিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে অনিবন্ধিত একটি অনলাইন পোর্টাল সংবাদ প্রকাশ করে। মুখরোচক সংবাদ প্রকাশ করার পর বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশ করা হয়। পরে নিউজটির সত্যতা না থাকায় নিবন্ধিত অনলাইন দৈনিক সিলেট ও দৈনিক যুগভেরী’র অনলাইন সংস্করণ থেকে কর্তৃপক্ষ নিউজটি সরিয়ে নেন। এই নিউজের জের ধরে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ইউনাইটেড মেটারনিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. কিশলয় সাহার নির্দেশে তদন্তের জন্য যান গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তদন্তকারী দুই কর্মকর্তা জুনিয়র কনসালটেন্ট (এনেস্থিসিয়া) ডাক্তার মিজানুর রহমান মামুন ও জুনিয়র কনসালটেন্ট গাইনী (অব) ডাক্তার সবিনা আক্তার। এই দুই জন কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখেন প্রতিষ্ঠানের মালিক সাংবাদিক মো. ইসলাম আলী নন, আলী আকর রাসেল সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক। এর কিছুক্ষণ পরেই সেখানে পুলিশ নিয়ে উপস্থিন হন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাঈদুল ইসলাম। বুধবার দুপুরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাঈদুল ইসলাম ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। এ সময় তিনিও ইউনাইটেড মেটারনিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিভিন্ন কাগজপত্র যাচাই করেন। কিন্তু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদনের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখেন প্রতিষ্ঠানের মালিক ইসলাম আলী নন। তবে প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ কর্মকর্তার কাগজপত্র সঠিক দেখেন তিনি। সবকিছু পর্যালোচনার পর ভ্রাম্যমাণ আদালত সাঈদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ইসলাম আলীকে ভোক্তা অধিকারের বিধি মোতাবেক ৫০হাজার টাকা জরিমানা করেন এবং ক্লিনিক আপাতত বন্ধ এবং ফার্মেসি চালু রাখার নির্দেশ দেন।
তবে সেই সময় ইসলাম আলী ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদুল ইসলামকে বলেন তাঁর নিকট ২৫ হাজার টাকা আছে। তিনি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, আর কোনো টাকার তার কাছে নেই। ফতেপুর ইউপির চেয়ারম্যান মিনহাজ উদ্দিন ও এলাকাবাসীও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অনুরোধ করেন ২৫ হাজার টাকায় ইসলাম আলীকে ছেড়ে দিতে, তিনি গরীব লোক। অনেক কাকুতি-মিনতির পর যখন ম্যাজিস্ট্রেটের মন গলেনি, তখন ইসলাম আলী নিজ থেকেই জেল হাজতে যাওয়ার জন্য গিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠেন।
পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদুল ইসলাম সাংবাদিক ইসলাম আলীকে নিয়ে গোয়াইনঘাটের পথে রওয়ানা হন। তবে বেলা ২টার দিকে তার তিন ভাই জালাল মিয়া, স্থানীয় দৈনিক শ্যামল সিলেট’র স্টাফ রিপোর্টার নিজাম উদ্দিন টিপু ও সিলেট ল’ কলেজের ছাত্র হিলাল উদ্দিন শিপু ধার দেনা করে আরো ২৫হাজার টাকা জোগাড় করে জরিমানার মোট ৫০হাজার টাকা নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গোয়াইনঘাট উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাঈদুলের কাছে যান। তখন তিনি ৫০হাজার টাকা গ্রহণ না করে ইসলাম আলীর বিরুদ্ধে গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ থেকে একটি নিয়মিত মামলা হবে বলে জানান। তবে সাংবাদিক ইসলাম আলীর ভাইয়ের জরিমানার টাকা নিয়ে ইসলাম আলীকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলে তিনি তাঁদের ধমক দিয়ে জানান আমার কাছে কোনও ক্ষমতা নেই, আপনারা গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. কিশলয় সাহার নিকট যান।
সেখান থেকে ইসলাম আলীর তিন ভাই যান ডা. কিশলয় সাহার কাছে এবং জরিমানার টাকা নিয়ে তাদের ভাইকে মুক্তি দিতে বলেন। তবে ডা. কিশলয় সাহা তাদের সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করেন এবং গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলামের কাছে যেতে বলেন। তখন তাঁরা আবারো ছুটেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে, কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা তাকে পাননি। না পেয়ে মুঠোফোনে কল দিলে তিনি তাদের কল রিসিভ করেননি। তারপর তারা যান গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হারুনুর রশীদের কাছে। তিনি তিন ভাইকে আশ্বস্ত করে বলেন তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ এখনো আসেনি আপনারা যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করেছেন তার কাছে আবারো গিয়ে অনুরোধ করেন তাকে ছেড়ে দিতে পারেন। এভাবে তিন ভাই জালাল, নিজাম ও হিলালের কেটে যায় ১১ ঘন্টা। আশ্বাসে তারা বসে থাকেন থানার আশোপাশে কখন জরিমানা নিয়ে ইসলাম আলীকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কারণ বেলা ২টা থেকে রাত ১২ পর্যন্ত তারা বিভিন্ন কর্মকর্তার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। ইসলাম আলীকে ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্র্তৃক দেয়া টাকা নিয়ে বসে আছেন।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে ইসলাম আলী ছোট ভাই সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন টিপু আবারো জরিমানা করা ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদুল ইসলামের সাথে কথা বলেন। তখন তিনি নিজাম উদ্দিন টিপুকে জানান, তিনি ইউনাইটেড মেটারনিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কোনও ধরেনর মোবাইল কোর্ট বা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেননি। তিনি ওইখানে গিয়েছিলেন শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় এবং ইসলাম আলীকে তিনি কোনও ধরনের অর্থদন্ড দেননি। তবে নিজাম উদ্দিন টিপু তাকে বলেন আপনি যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন এবং অর্থদন্ড করেছেন তার ভিডিও, ছবি ও সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষিত আছে। এই কথার কোনো সদুত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদুল ইসলাম। এতে হতাশ হয়ে পড়েন সাংবাদিক ইসলাম আলীর ভাইয়েরা ও তার পরিবার। প্রশাসনে সাংবাদিক মো. ইসলাম আলীকে নিয়ে কি হচ্ছে, কি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আবারো তারা যান থানায় সেখানে গিয়ে ওসিকে বলেন আপনি কেন ইসলাম আলীকে আটক রেখেছেন। সেই উত্তরে ওসি হারুনুর রশীদ জানান, আমার কাছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদুল ইসলাম তাঁকে রেখে গেছেন। তাই কোনও রকম অভিযোগ ছাড়াই আমি তাকে রাখতে বাধ্য।
তবে রাত ১টার দিকে ঘুরে যায় দৃশ্যপট। একটি অভিযোগ আসে থানার ওসির কাছে। সেটি বিনা তদন্তে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে এফআইআর হিসেবে থানায় নথিভূক্ত করা হয়। যার মামলা নং (২০) এবং ইসলাম আলীর ভাই ল’ কলেজের ছাত্র হিলাল উদ্দিন শিপুও সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন টিপু বিনা তদন্তে কিভাবে ফোনে ইউএনও’র নির্দেশে মামলা দায়ের করা হয় এর জবাব চান। তখন ওসি হারুন জানান ভাই আমি অসহায়! আপনারা তো সাংবাদিক পাশাপাশি ছাত্র আপনারা বোঝার কথা।
এ ব্যাপারে সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন টিপু তার ভাই ওই ক্লিনিকের একজন কর্মচারী দাবি করে বলেন, আমার ভাইয়ের সাথে অন্যায় করছে প্রশাসন। যুবলীগ নেতা মাসুকের ইন্দনে তার ভাই ইসলাম আলীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে মাসুকের নির্ধারিত সেই যুবকের মাধ্যমে। তার ভাইকে যেহেতু মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে, তাহলে কেন নিয়মিত মামলা বা জরিমানা না নিয়ে যুবলীগ নেতা মাসুকের প্রেরিত অভিযোগ কারীর এজহারের ভিত্তিতে বিনাতদন্তে ওসি মামলা রেকর্ড করলেন।
তিনি আরো বলেন, ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সহযোগীরা এখনো ঘাপটি মেরে জায়াগায় জায়াগায় বসে আছে। এখনো যুবলীগ, আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায় ইউএনও নিজে মামলা রেকর্ড করান থানার ওসিকে ফোন দিয়ে। এটি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর লজ্জার একটি উদাহরন। তিনি অবিলম্বে তার ভাইকে গ্রেফতার ও পরিবারকে হয়রানী করায় গোয়াইনঘাটের ইউএনও মো. তৌহিদুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাঈদুল ইসলাম, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. কিশলয় সাহার অপসারন দাবি করেন।
এ ব্যাপারে দৈনিক সোনলী কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক সামসুদ্দিন আহমদ বলেন, ইসলাম আলী আমার পত্রিকায় ২৫ বছর ধরে কর্মরত। তাকে এভাবে প্রসাশন যন্ত্র ধারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হতে হবে তার চিন্তা করতে পরিনি। বিনাতদন্তে গভীর রাতে যুবলীগ নেতার অভিযোগকারী দিয়ে কিভাবে তার উপর নতুন বাংলাদেশে মামলা রেকর্ড হলো তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে স্থানীয়রা বলেন, এলাকার মানুষ এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একপক্ষ বিএনপি এবং অন্যপক্ষ আওয়ামী লীগ। বিএনপি পক্ষে সাংবাদিক ইসলাম আলীকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যামে লিখছেন এবং কিছু সংখ্যক আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতা মাসুকের হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম আলীর বিপক্ষে লিখছেন। ইসলাম আলী স্বেচ্ছায় আটক হওয়ার পর মাসুক আহমদ তার এলাকায় মিষ্টি বিতরণ কেন করেছে তা বোঝা যাচ্ছে। এখন সবকিছু পরিষ্কার ইসলাম আলী মূলত মাসুককে নিয়ে প্রতিবেদন করায় তাকে এই খেসারত দিতে হচ্ছে। আমারা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়ে বলতে চাই ইসলাম আলী মাসুকের বিরুদ্ধে যেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সেই প্রতিবেদন যদি সঠিক হয় তাকে ধরুন। তাকে কেন আপনারা লালন-পালন করছেন। আর নিরহ মানুষকে তার কথা জেলে দিচ্ছেন। এগুলো গোয়াইনঘাটের মানুষ মেনে নেবে নাহ।
এব্যাপারে সাংবাদিক ইসলাম আলীর পিতা আব্দুর নুর জানান, আমার ছেলে নিরপরাধ। সে একবার মেম্বার ও ৩বার চেয়ারম্যান এবং গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং উপজেলা নির্বাচনে সে ৯ হাজার ৯৬৮ ভোট পায়। মূলত সে সমাজসেবায় তার পুরো জীবনটাই কাটিয়ে দিয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সে সব সময় সোচ্ছার থাকে। আজ যুবলীগ নেতা মাসুক বাহিনী ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং নামধারী কিছু সাংবাদিক আমার ছেলে ও পরিবারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে আমার পরিবারের লোকজনের ক্ষতির হুমকি পাচ্ছি। আমরা এখন অসহায় অবস্থায় আছি। যে কোন সময় আমার পরিবারের লোকদের উপর হামলা ও ভুয়া মামলা হতে পারে। আমি দেশের প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও আমার ছেলের উপর যুবলীগ ও প্রশাসন মিলে যে অন্যায় করেছে তার বিচার চাই।
উল্লেখ্য, ৯ সেপ্টেম্বর (সোমবার) ‘গোয়াইনঘাটে যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে অটোরিকশাচালক থেকে শতকোটি টাকার মালিক মাসুক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেখানে মাসুক সহ গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তার দুর্নীতির চিত্র ফুটে ওঠে। সেই থেকে মাসুক, তার বাহিনী ও কতিপয় নামধারী সাংবাদিক এবং প্রশাসন এক হয়ে ইসলাম আলীকে সায়েস্তা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এবং সর্বশেষ একটি ভুয়া মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

ফেসবুকে সিলেটের দিনকাল